দরকার ডিসিপ্লিন

ডিসিপ্লিনের কথা শুনে হ্যান্ডশেক

     সুমিত আর অনন্ত দুই বন্ধু। কতকাল আগের সম্পর্ক। বন্ধুত্ব সমান ব্যক্তিত্বের মধ্যে হয়ে থাকে সাধারণত। চালাকের সাথে চালাকের, বোকার সাথে বোকার, শিক্ষিতের সাথে শিক্ষিতের, অশিক্ষিতের সাথে অশিক্ষিতের। কিন্তু এরা ছিল দুটি ভিন্ন মানুষ। 

     সুমিত ছিল পুরোপুরি ডিসিপ্লিনড। আর অনন্ত ছিল পুরো আনডিসিপ্লিনড।

     সেদিন ফার্মেসিতে গিয়েছিল দুজন একসাথে। সুমিত বলল, ‘অনন্ত তুই কাফ সিরাপ নিবি। আমার জন্য একটা মাথাব্যথার ওষুধ নিস।’

     দোকানে ভিড়। অনন্ত সবার পিছন থেকে চিল্লে উঠল, ‘একটা ভালো কাফ সিরাপ দিন। আর দুটো মাথাযন্ত্রণার ট্যাবলেট।’

     ফার্মেসিতে তিনজন কর্মী ছিল। কেউ পাত্তা দিল না। যেন তারা অনন্তর কথা শুনতেই পায়নি। 

     অনন্ত সুমিতকে বলল, ‘দেখছিস সেলসম্যানগুলো কেমন গাধা। শুনলই না আমার কথা!’

     সুমিত শান্ত ভাবে বলল, ‘তোর ভুল হচ্ছে। আমাদের আগে কতজন দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ। ওরা আমাদের চেয়ে আগে এসেছে। ওদের কেউ কেউ অনেক আগে এসেছে। ওরা নিক। আমরা লাইনে দাঁড়াই। আমাদের পালা আসলে আমরা চাইব। দোকানদার নিশ্চয়ই শুনবে।’

     ওরা লাইনে দাঁড়াল। মিনিট চারেক পর ওদের সময় আসতেই ওরা বলল। দোকানদার ওষুধ দিয়ে দিল।

     তার তিনদিন পরের ঘটনা। সুমিত আর অনন্ত বেরিয়েছে দুজন দুটো বাইক নিয়ে বেড়াবে বলে। আজ দুজনের ছুটি। সুমিতের স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস, আর অনন্তর অফিস থেকে একটা ক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছে।

     পঁচিশ বছরের বয়সের এই দুই অবিবাহিত ছেলে বাইক হাঁকিয়ে কত দূর দূর চলে যায়। বিয়ের জন্যে দুজনেরই মেয়ে দেখা চলছে। ছাত্রজীবন থেকেই এরা বন্ধু। একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত।

     সে যাইহোক, এরা আজ ডায়মন্ড হারবার যাবে। সকাল ১০টায় বেরিয়েছে।

     ধোপাগাছি পর্যন্ত গিয়ে সুমিত বলল, ‘চল অনি টিফিন করে নিই। সাড়ে ১০টা বাজতে যায়।’

     দুজনে পরোটা আলুরদম আর ডিম সেদ্ধ খাবে ঠিক করল। রাস্তার ধারে বাইক রেখে একটা পরোটার দোকানে ঢুকল।

     খাচ্ছে, এমন সময় একটা লোক রাস্তার ওপর থেকে ‘এ-ই-ই বাইক কার আছে...বাইক কার...?’ বলে চিল্লাতে লাগল।

     রাস্তায় জ্যাম হয়ে গেছে। অনন্তর বাইক। রাস্তার অনেকটা ওপর পর্যন্ত রাখা। সুমিত বলল, ‘যা অনি বাইকটা সাইড করে আয়।’

     ‘যত্তসব,’ খাওয়া ফেলে গজগজ করতে করতে অনন্ত গেল।

     একজন বলল, ‘এভাবে রাস্তার ওপর বাইক রাখে?'

     সন্ধেয় ওরা ডায়মন্ড হারবারে নদীর ধারে বসে আছে। কলা কিনেছে চারপিস। খাচ্ছে বার নদীর ওপর লঞ্চ, জাহাজ, নৌকা দেখছে। কত সুন্দর লাগছে জায়গাটা।

     গোল বাধল তখনই যখন অনন্ত একটা কলার খোসা রাস্তার দিকে ছুড়ে দিল। ট্রাফিক পুলিশ ওকে এসে বলল, ‘দাদা এটা কী করলেন। যান ওটাকে অন্য কোথাও ফেলে আসুন।’

     অনন্ত উঠল না দেখে সুমিত গিয়ে ওটা হাতে করে নিয়ে রাস্তার পাশে ঝোপজঙ্গলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে আসল।

     ভালোই কাটল দিনটা ওদের। বাড়ি ফিরল রাত ১১টায়।

     পরদিন সকালে অফিস যেতে হবে ওকে। সুমিত স্কুলে চলে গেছে। এদিকে অনন্ত ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাড়ে ১১টা। 

     যাঃ! আজও অফিস কামাই হল। এত দেরিতে বেরোলে হবে না। ও রোজ সাড়ে ৯টায় বেরোয়। সে জায়গায় এখন সাড়ে এগারোটা। দুপুর ১২টায়  রওনা দেওয়া যায় না। অফিসে পৌঁছতে দেড়টা বেজে যাবে।

     বাড়ি ফাঁকা। সবাই ওর পিসির বাড়ি গড়িয়াতে আছে। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল ও। বেজেছিল। তাতেও ঘুম ভাঙেনি।

     সন্ধ্যায় ধাবায় বসে চা খেতে-খেতে অনন্ত সুমিতকে বলল, ‘সুমিত আমি যেখানেই যাই অপদস্থ হই। অপমানিত হই। কেন বল তো। আমি কারওর ক্ষতি করি কিছু? তাও।’

     সুমিত শান্তভাবে বলল, ‘ডিসিপ্লিনের অভাব। কিছু মাইন্ড করিস না, সেদিন ওষুধের দোকানে গিয়ে সবার পিছন থেকে ওরকম ওষুধ চাইলি কেন? তোর তো লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা উচিত ছিল। তারপর ঘুরতে যাবার দিন বাইকটা ঠিক করে সাইড করলি না। রাস্তার ওপর উঠিয়ে রেখেছিলিস। আরও আছে। ডায়মন্ডে কলার খসাটা পথের ওপর ফেলা কি ঠিক হয়েছে তোর? তারপর তুই জানিস পরদিন তোর অফিস। মোবাইলে  অ্যালার্ম আস্তে বাজে তুই জানতিস। তোর অ্যালার্ম ঘড়ি আছে। তাতে অ্যালার্মটা সেট করলি না কেন? এগুলো সব পার্সোনাল ডিসিপ্লিনের অভাব। মানে ব্যক্তিগত নিয়মানুবর্তিতা।’

     অনন্ত বুঝতে পারল। বলল, ‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি এগুলোর কোনোটাই ঠিক কাজ ছিল না আমার। তাই লোকের কথা শুনেছি। আর অপমানিত হয়েছি।’

     সুমিত বলল, ‘এই এত বড় পৃথিবী চলছে নির্দিষ্ট নিয়মে। এমনকী প্রকৃতির সবকিছু সূর্য চাঁদ তারা আকাশ জলবায়ু মানুষ জীবজন্তু গাছপালা নদনদী সাগর মহাসাগর, এমনকী কীটপতঙ্গ সব চলেছে একটা ধরাবাঁধা নিয়মে। সেখানে কেউ যদি অনিয়ম করে তাকে তো ক্ষতিস্বীকার করতেই হবে। অপমানিত হতেই হবে।’

     অনন্ত চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে কঠিন সুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আজ থেকে আমি শপথ নিলাম সুমিত, যখন যেখানে থাকব সেখানকার নিয়ম মানব। নিজের খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলব না।’

     ‘তাহলেই সম্মানিত হবি, লাভবান হবি, মনে শান্তি পাবি, বাঁচতে ভালো লাগবে,’ বলল সুমিত।

     ‘ওকে ডান’ বলে অনন্ত হাত মেলাবার জন্য সুমিতের দিকে হাত বাড়াল৷ সুমিত একটা স্মাইল দিয়ে হাত বাড়াল।


বার্তা - ডিসিপ্লিন ছাড়া উন্নতি করা যায় না। এটি মানুষকে মর্যাদা দান করে। 


Image Source : Pixabay


     

    

Comments

  1. প্রিয় বন্ধু, গল্পটি কেমন লাগল জানাবেন...

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মোবাইলে মুশকিল

আঁখিতে প্রেম